লীলাকীর্তন:
কীর্তনের নানা প্রকরণের ভিতরে লীলাকীর্তন সর্বপ্রাচীন বলে মান্য করা হয়। মূলত বৈষ্ণবরা রাধাকৃষ্ণের পার্থিব প্রেমকে বিষ্ণু'র লীলা হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। এই লীলাকে গানের ভিতর দিয়ে উপস্থাপনই হলো লীলা কীর্তন বলা হয়। এক্ষেত্রে রাধাকৃষ্ণের লীলার কাহিনির ধারাক্রম অনুসরণ না করে, পৃথক পৃথক গান হিসেবে পরিবেশন করা হয়। লীলাকীর্তনের আসরে বিভিন্ন শিল্পীরা ইচ্ছা মতো গান পরিবেশন করে থাকেন। ফলে লীলাকীর্তনের আসর হয় অনেকটা কীর্তনের বিচিত্রানুষ্ঠান। শ্রীচতন্যের আবির্ভাবে পূর্বে এই কীর্তন হতো মূলত কীর্তনের আখড়াতে। এই বিচারে বলা যায়, এই কীর্তনকে আখড়াই কীর্তনও বলা যায়।
লীলাকীর্তনে শুরুর দিকে কীর্তনের সুরে লোকসুরের প্রভাব ছিল। কালক্রমে এর সাথে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সুর ও তালের প্রয়োগ শুরু হয়েছিল। সুর তালের বৈচিত্র্যর সূত্রে লীলাকীর্তনে যুক্ত হয়েছিল তাল ফেরতা এবং নানাধরনের শাস্ত্রীয় তাল। একতাল, ঝাঁপতালের মতো প্রথাগত শাস্ত্রীয় তালের পাশাপাশি লোফা, দশকোশীর মতো জটিল তালের প্রয়োগ শুরু হয়েছিল এবং এখনও তা চলছে।পালা-কীর্তন: লীলাকীর্তনের শুরুর দিকে আখ্যানভিত্তিক ঝুমুর গানের চর্চা শুরু হয়েছিল। একই ধারায় পালকীর্তনে শুরু হয়েছিল। ধারণা করা হয় বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকৃর্তনের আমলেই পালা-কীর্তনের ধারাটি প্রবর্তিত হয়েছিল। পালা-কীর্তনে কাহিনি রাধাকৃষ্ণের লীলাকে বিভিন্ন পর্বে ভাগ করে গানে গানে পরিবেশন করা হয়। এতে শিল্পীরা গানের পাশাপাশি অভিনয় করে থাকেন। মূলত পালাকীর্তন গড়ে ওঠে বহু লীলাকীর্তনে সমাহারে।
পালা-কীর্তন দলগত পরিবেশনা। তাই এর একজন পরিচালক থাকে। এদেরকে বলা হয় অধিকারী। প্রথাগতভাবে বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তনকে ভেঙেই অধিকারীরা নিজেদের মতো করে পালা সাজাতেন। এদের প্রচলিত লীলাকীর্তনের পাশাপাশি নিজেদের রচিত গান যুক্ত করতেন। অনেক সময় প্রথাগত পালাকীর্তনের ধারার সাথে নিজেদের ভাবনা থেকে নতুন আঙ্গিকের কোনো অধ্যায় যুক্ত করতেন। এরূপ একটি অধ্যায় ছিল 'কলঙ্কভঞ্জন'। অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতাব্দীতে 'কলঙ্কভঞ্জন' নামে পালাকীর্তনে পৃথকভাবে একটি অধ্যায় ব্যবহৃত হতো। কৃষ্ণের সাথে প্রণয়, কলহ, মান-অভিমানের সূত্রে কলঙ্ক রটতে পারে, এই কলঙ্কমোচনের দায় গায়েন নিজেই গানে গানে মোচন করতেন। কখনো অতিরিক্ত কাহিনিও যুক্ত করতেন। কলঙ্কভঞ্জনের এই বিষয়টি অনেক সময় সেকালের কৃষ্ণবিষয়ক পালাগান বা কবি গানেও ব্যবহৃত হতো।
পালকীরতন পরিবেশনায় কিছু শৃঙ্খলা মান হয়। মূলত মূল পালা-কীর্তন আরম্ভের শুরুতে কিছু বিশেষ গান বা
লীলাকীর্তন ও পালাকীর্তনের পর কীর্তনে নব্যধারা যুক্ত হয়েছিল নাম-কীর্তন।নাম-কীর্তন: ১৫১০ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে বাংলার বৈষ্ণবদের ভিতরে লীলা কীর্তনের চর্চা ছিল। ১৫০০খ্রিষ্টাব্দের দিকে নদীয়ায় অদ্বৈতাচার্য, যবন হরিদাস এবং শ্রীবাস পণ্ডিতরা বৈষ্ণবপন্থীরা নিয়মিত আখড়াই লীলাকীর্তনের চর্চা করতেন। ১৫১০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে শ্রীচৈতন্য এই বৈষ্ণবগোষ্ঠীর অন্যতম সদ্স্য হিসেবে যোগদান করেন। পরে তিনি এই গোষ্ঠীর নেতৃত্ব দেন। তিনিই প্রচলন করেছিলেন নাক-কীর্তন। কৃষ্ণের আরাধনার সহজতর উপায় হিসাবে, সুর ও ছন্দে এঁদের নাম ক্রমাগত উচ্চারণের রীতি প্রচলন করেন। একে বলা হয় সংকীর্তন। শ্রীচৈতন্য তাঁর ভক্তদের নিয়ে নগর পরিক্রমা করতেন। সে সময়ে এই কীর্তনকে বলা হতো 'নগর-কীর্তন'।এই সংকীর্তন বা নগর-কীর্তনে- হরে (বিষ্ণুর অপর নাম) এবং কৃষ্ণ এব রাম (বিষ্ণুর অবতার) নাম ৩টি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সুর-সহযোগে আবৃত্তি করার মধ্য এই কীর্তনের যে ধারাটি প্রচলিত হয়েছিল, তার সাধারণ নাম 'নাম-কীর্তন। নাম-কীর্তনের রূপটি হলো-
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ
কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে
হরে রাম হরে রাম
রাম রাম হরে হরে