হযরত ওসমান ইবনে আফফান (রা.) : হযরত ওসমান (রা.)-এর জীবনে প্রাথমিক অর্থাৎ, জাহেলী যুগের অবস্থা অন্যান্য কিছুসংখ্যক সাহাবায়ে কেরামের মত আংশিক অনুদঘাটিত এবং ইতিহাসের আওতার বাহিরে রহিয়া গিয়াছে। ইসলাম আবির্ভূত হইয়া এ সমস্ত মহা পুরুষের জীবন-যাপন পদ্ধতি, তাঁহাদের অন্তঃকরণ এবং তাঁহাদের চিন্তাধারাকে পরিবর্তন করিয়া নূতন ছাঁচেই কেবল গড়িয়া তোলে নাই; বরং তাঁহাদের জন্য সম্পূর্ণ এক নূতন ইতিহাসের গোড়াপত্তন করিয়াছে। ফলতঃ হযরত ওসমান (রা.)-এর ইসলাম-পূর্ব জীবন এইরূপে কাটিয়াছে, যেন ইসলামের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই তিনি জন্মগ্রহণ করিয়াছেন। কথিত আছে, তিনি হাতী বাহিনীর ঘটনার সাত বৎসর পর তায়েফ নগরীতে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন।
সম্ভবতঃ তাঁহার প্রাথমিক জীবনের ইতিহাস সম্পর্কিত রেওয়ায়াতগুলি সনদবিহীন। এই সম্ভাবনাটি সত্য হওয়ার প্রকৃষ্ট প্রমাণ এই যে, শহীদ হওয়ার সময় তাঁহার বয়স কত ছিল এ সম্বন্ধে বিভিন্ন প্রকারের রেওয়ায়াত পাওয়া যায়। ঐতিহাসিকগণ এ বিষয়ে একমত নহেন। কেহ বলেন ৭৫ বৎসর, কেহ বলেন ৮৮ বৎসর, কেহ বলেন ৯০ বৎসর আবার কাহারও কাহারও ধারণায় ৮২, ৮৩ কিংবা ৮৬ বৎসর। তাঁহার জন্মগ্রহণের সঠিক তারিখ জানা থাকিলে, সে সম্বন্ধে এত মতভেদ কখনও হইত না। মোদ্দাকথা, তিনি কোন্ সনে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন, ইহার কোন সঠিক ও সপ্রমাণিত বিবরণ পাওয়া যায় না। কেননা, জন্ম এবং মৃত্যুর সঠিক দিন ও তারিখ লিখিয়া রাখার রীতি তৎকালীন আরবে প্রচলিত ছিল না।
আরব জাতি অসাধারণ স্মরণশক্তির জন্য বিখ্যাত ছিল। তাহারা বিশেষ বিশেষ ঘটনা সযত্নে মনে রাখিয়া দিত এবং সে সমস্ত ঘটনার উপর ভিত্তি করিয়া অন্যান্য নূতন ঘটনার সময় ও তারিখ নির্ণয় করিত। যেই বৎসর ইয়ামানের গভর্নর আবরাহা হাতী বাহিনী লইয়া কা'বা গৃহ ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে মক্কা আক্রমণ করিয়াছিল, সেই বৎসরটিকে আরবরা 'আম-আল-ফীল' অর্থাৎ, 'হস্তি বর্ষ' নামে অভিহিত করিত। এই বৎসরটি আরবের অধিবাসীদের নিকট একটি চিরস্মরণীয় ঘটনার কারণে ঐতিহাসিক গুরুত্ব লাভ করিয়াছিল। কোরআন শরীফের 'সূরাতুল্ ফীলে' (আলাম্ তারায়) এই ঘটনাই উল্লিখিত হইয়াছে। এই ঘটনাটি ৫৭১ খ্রীষ্টাব্দে সংঘটিত হইয়াছিল। এই সনেই হযরত মোহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্ম হয়। ইহার ছয় অথবা সাত বৎসর পর হযরত ওসমান (রা.) জন্মগ্রহণ করেন। এই হিসাবে হযরত ওসমান (রা.)-এর জন্ম হয় ৫৭৭ বা ৫৭৮ খ্রীষ্টাব্দে। হযরত রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে বৎসর মক্কা হইতে মদীনায় হিজরত করেন সে বৎসর হযরত ওসমান (রা.)-এর বয়স ৪৭ বৎসর ছিল বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বয়স তখন ৫৩ বৎসর। সেই হিসাবে হযরত ওসমান (রা.)-এর জন্ম ৫৭৭ খৃষ্টাব্দে হয় বলিয়া বুঝা যায়।
হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.) নবী করীম (সা.) হইতে দুই বৎসরের ছোট ছিলেন। এই হিসাবে হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.) হযরত ওসমান (রা.)-এর চেয়ে চার বা পাঁচ বৎসরের বড় ছিলেন। হযরত ওমর ফারূক (রা.) নবী করীম (সা.)-এর চেয়ে তের বৎসরের ছোট ছিলেন। সুতরাং তিনি হযরত ওসমান অপেক্ষা অন্ততঃ ছয় বৎসরের ছোট ছিলেন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এন্তেকালের সময় হযরত আবু বকর (রা.)-এর বয়স ছিল ষাট বৎসর এবং হযরত ওমর ফারুক (রা.)-এর বয়স তখন ৫০ বৎসর, আর হযরত আবু বকর ও হযরত ওমর (রা.)-এর ঘনিষ্ট সহচর হযরত আবু ওবায়দার বয়স ছিল তাঁহাদের দুইজনের মাঝামাঝি।
হযরত ওসমান (রা.)-এর প্রাক ইসলামী যুগের জীবন সম্পর্কে সবিস্তার তথ্য পাওয়া না গেলেও তাঁহার 'নসবনামা' অর্থাৎ বংশ লতিফা রাবীদের নিকট হইতে সঠিকভাবে পাওয়া যায়। তাঁহার বংশ পরম্পরা এইরূপ-ওসমান ইবনে আফ্ফান, ইবনে আবিল আস, ইবনে উমাইয়্যা, ইবনে আব্দে শাম্স, ইবনে আব্দে মনাফ, ইবনে কুসাই। অর্থাৎ, তাঁহার বংশধারা পিতার দিক হইতে ঊর্ধ্বতন পুরুষ আবদে মনাফ পর্যন্ত গিয়া রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পূর্ব পুরুষের সহিত মিলিত হয়। মায়ের দিক হইতে এই বংশগত সম্পর্ক হুযূর (সা.)-এর আরও নিকটবর্তী হইয়া যায়। কেননা, হযরত ওসমানের মাতার নাম ছিল আরওয়া এবং তাঁহার বংশধারাও ঊর্ধ্বতন পঞ্চম পুরুষে গিয়া হুযুর (সা.)-এর বংশের সহিত মিলিত হয়। অর্থাৎ, আরওয়া বিনতে কুরাইয, ইবনে রবীআহ্, ইবনে হাবীব, ইবনে আব্দে শামস্, ইবনে আব্ন্দে মনাফ। আব্দে মনাফের দুই পুত্রের মধ্যে একজনের বংশে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং অন্য পুত্রের বংশে হযরত ওসমান (রা.)-এর জন্ম হয়। হযরত ওসমানের মাতা আরওয়া ছিলেন রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ফুফু উম্মে হাকিম বায়যা বিন্তে আব্দুল মুত্তালিবের কন্যা। হুযুরের এই ফুফু তাঁহার পিতা হযরত আবদুল্লাহ্র যমজ ভগ্নি ছিলেন। অতএব, হযরত রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আপন ফুফু হইলেন হযরত ওসমান (রা.)-এর নানী। হযরত ওসমান (রা.)-এর বংশ মক্কায় খুবই সম্ভ্রান্ত ও সম্মানিত বলিয়া গণ্য হইত।