‘একেই কি বলে সভ্যতা?’-র কাহিনী গড়ে উঠেছে নব্যবঙ্গের যুবকদের উচ্ছৃঙ্খলতা, মদ্যপান ও ব্যাভিচারের কাহিনিকে কেন্দ্র করে। কালী এবং নববাবু এই দুজন নব্যযুবকের কথোপকথনে কাহিনীর সূত্রপাত। কালী নবকে তাদের প্রতিষ্ঠিত ‘জ্ঞানতরঙ্গিনী সভায়’ নিয়ে যেতে এসেছে, যাকে তারা বলে 'স্বাধীনতার দালান'। নবকুমার সেই সভার চেয়ারম্যান; কিন্তু সম্প্রতি তার একটু অসুবিধা দেখা যাচ্ছে। তার পরমবিজ্ঞ পিতা সম্প্রতি বৃন্দাবন থেকে কলকাতার বাড়িতে ফিরে এসেছেন। নববাবু পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত বিবাহিত যুবক। তার সংসারে আছেন তার মাতা, স্ত্রী, বোন প্রভৃতি। স্ত্রী এবং বোন নবকুমারের ‘জ্ঞানতরঙ্গিনী সভার’ কার্যাবলী সম্পর্কে অভিজ্ঞ ও সচেতন। কিন্তু নবকুমারকে তার মা অতটা হীন মনে করতে পারেন না। নবকুমারের পিতা কলকাতায় আসায় তার যথেষ্ট অসুবিধা হয়েছে; কেন না কর্তাবাবু ছেলেকে সর্বদা চোখে চোখে রাখতে চান। কলা কৌশলের সঙ্গে কর্তাবাবুকে ধাপ্পা দিয়ে নবকে সভায় নিয়ে গেল। কালীর কথাবার্তায় কর্তার মনে সংশয় জেগে উঠলে তিনি তাঁর সহচর বৈষ্ণববাবাজীকে পুত্রের কার্যকলাপের সম্বন্ধে অনুসন্ধান করতে অনুরোধ জানালেন। সিকদার পাড়ার গলিতে গিয়ে বিচিত্র অভিজ্ঞতা লাভ করে বৈষ্ণববাবাজী বুঝলেন যে পল্লীটি নিষিদ্ধ পল্লী। নবকুমার ও কালীর সঙ্গে দেখা হলে তারা বৈষ্ণব বাবাজীকে উৎকোচ দিয়ে তার মুখ বন্ধ করতে চাইলো। তারপর ‘জ্ঞানতরঙ্গিনী সভায় গিয়ে স্বাধীনতা চর্চার নামে নবকুমার মদ্যপান, হুল্লোড়, বেলেল্লাপনা, গণিকাচর্চা ইত্যাদির পর গভীর রাত্রে গৃহে প্রত্যাবর্তন করতে লাগলো। নবকুমারের গৃহে প্রত্যাবর্তনের পূর্বে তার স্ত্রী ও বোনেদের দুঃখ-বেদনার কথা বর্ণিত হয়েছে। প্রলাপমত্ত পুত্রকে দেখে কর্তাবাবু পুত্রের ক্রিয়াকর্ম উপলব্ধি করলেন এবং কলকাতার বাস উঠিয়ে বৃন্দাবনে প্রত্যাবর্তনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন।
‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ' প্রহসনের সূচনাতেই ধর্মধ্বজী, ভণ্ড, বৃদ্ধ, ধনী, কৃপণ জমিদার ভক্তপ্রসাদের ব্যভিচারী রূপের পরিচয় প্রদান করা হয়েছে। তার এই চরিত্রগত পরিচয় ব্যক্ত হয়েছে ‘পুঁটি এবং গদাধর’ নামে দুটি চরিত্রের কথোপকথনে—যারা জমিদারের কুকর্মের অনুচর। পুঁটির কথাবার্তা থেকে জানা যায় যে, সে প্রায় ত্রিশ বৎসরের বেশি সময় জমিদারের সঙ্গে কাজ করেছে এবং কত বৌ-মেয়ের যে সর্বনাশ করেছে তার ইয়ত্তা নেই। ভক্তপ্ৰসাদ বাইরের দিকে পরম বৈষ্ণব, সর্বদাই মালা জপ করে। হানিফ গাজী জমিদারের একজন রায়ত' নিদারুণ খরার জন্য তার ক্ষেতের ফসল নষ্ট হওয়ায় সে খাজনা দিতে পারে নি। হানিফ খাজনার কিছু অংশ দিতে চায়, বাকি অংশ ছাড়ের জন্য অনুনয় বিনয় করলেও ভক্তপ্রসাদ তাতে সম্মত হয় না। এই সময় ভক্তপ্রসাদ গদাধরের মারফৎ জানতে পারে যে হানিফের ঘরে উনিশ বছরের সুন্দরী যুবতী স্ত্রী আছে। তাকে পাবার আশায় জমিদার তার খাজনা মুকুব করে দেয়। জমিদার ভক্তপ্রসাদের সর্বগ্রাসী রূপের পরিচয় পাওয়া যায় যখন সে পঞ্চানন বাচস্পতির ব্রহ্মত্র জমি গ্রাস করে। বাচস্পতি মাতৃহীন হলে ভক্তপ্রসাদের কাছে সামান্য অর্থ সাহায্যের জন্য এলে জমিদার তার অনুরোধে কোনো কর্ণপাত না করে তাকে বিদায় করে দেন। পীতাম্বর তেলীর যুবতী কন্যা পাঁচীর জন্য ভক্তপ্রসাদ ব্যাকুল হলে গদাধর জানায় অর্থে সমস্ত সম্পন্ন হয়। জমিদার এসব ব্যাপারে অর্থ খরচে কৃপণতা করে না।
বাংলা নাটক ও রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসের আধুনিক পর্বে এক অবিস্মরণীয় নাম উৎপল দত্ত। গিরিশচন্দ্রের পর বাংলা নাট্য-ইতিহাসে উৎপল দত্তের মধ্যেই দেখা যায় নট, নাট্য পরিচালক ও নাট্যকার প্রতিভার অতুলনীয় সমন্বয়।
ভারতীয় গণনাট্য সংঘ বাংলা নাটককে যেভাবে সমাজ পরিবর্তনের অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করেছিল, বিজন ভট্টাচার্যের নাটকে যার পরিচয় আমরা পেয়েছি, তাকেই আরও অগ্রসর ও শিল্পসম্মত রূপ দান করেছিলেন উৎপল দত্ত।
ভরতমুনির নাট্যশাস্ত্র থেকে জানা যায় ঋকবেদের ‘পাঠ’ শ্রব্য, সামবেদের ‘গান’ শ্রব্য, যজুর্বেদের ক্রিয়াকাণ্ড বা অভিনয় দৃশ্য, অথর্ববেদের ‘রস’ দৃশ্য-শ্ৰব্য সংবেদ্য ভাব – এই চারটি উপাদানকে সংযুক্ত করে ‘নাট্য’-এর উৎপত্তি।
আমরা বাঙলা ভাষায় ট্র্যাজেডিকে বিয়োগান্ত নাটক বলে থাকি। কিন্তু নাটকের পরিসমাপ্তি বিয়োগান্ত হলেই তা ট্র্যাজেডির মর্যাদা লাভ করে না। কখনও কখনও পরিণতি সুস্পষ্টরূপে বিয়োগান্ত না হলেও তার মধ্য দিয়ে ট্র্যাজেডির ভাব ও রূপগত বৈশিষ্ট্য উদ্ভাসিত হতে পারে। ট্র্যাজেডির ভাববৈশিষ্ট্য ও তার বিশেষ রসের ধ্যানধারণা আমরা ইয়োরোপের বিভিন্ন ট্র্যাজেডি ও তাদের আলোচনা থেকেই পেয়েছি।ট্র্যাজেডির ধারণা ভারতীয় নাট্যচিন্তায় ছিল না। সংস্কৃত অলংকার শাস্ত্রবিদেরা নাটকে বিয়োগান্ত পরিণতিকে কোনও স্থান দিতে চান নি।