চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে যে দেবীর মাহাত্মা কীর্তন করা হয়েছে, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস আলোচনাতেও দেখা যায় সমগ্র প্রাচীন ও মধ্যযুগ জুড়ে ছিল পদ্যের একাধিপত্য সেই পদ্যে রচিত হয়েছে অসংখ্য গীতিকবিতা এবং কাহিনীকাব্য। এই কাহিনী কাব্যের প্রধান ধারাটিই ছিল মঙ্গলকাব্য। মঙ্গলকাব্যগুলিতে কাহিনীর বৈচিত্রা থাকলেও সেগুলি মূলত দেবযানী সাহিত্য অর্থাৎ মঙ্গলকাব্যে কোন-না-কোন দেবতার মাহাত্ম্য-কীর্তনই ছিল প্রধান লক্ষ্য এবং সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্যই উপলক্ষ রূপে রচিত হ'য়েছিল বিস্তর মানব-মানবীর কাহিনী। কিন্তু কাহিনীগুলিতে অলৌকিকতার প্রভাব থাকায় সেগুলি মানব-সম্পর্কিত হলেও মানবিক গুণসম্পন্ন হয়ে উঠতে পারেনি। বহু কবি একই কাহিনীকে অবলম্বন ক'রে স্ব-স্ব প্রতিভা অনুযায়ী কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি করলেও কাহিনী কিংবা চরিত্র–কোনটিকেই পরিপূর্ণভাবে বিকশিত করে তুলতে পারেন নি। এই গতানুগতিকতার যুগে ষোড়শ শতকে আবির্ভূত কবি মুকুন্দ চক্রবর্তীহি অসাধারণ বৈশিষ্ট্য অর্জন ক'রে কাহিনী ও চরিত্রে প্রাণস্পন্দন সৃষ্টি করে সেকালের পক্ষে প্রায় অস্বাভাবিক এক নতুন বস্তু সৃষ্টি করলেন —যাকে একালের পরিভাষায় আমরা প্রায় উপন্যাসের মর্যাদা দান করতে পারি। বাংলা সাহিত্যে উপন্যাসের ধারা সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে মনীষী প্রাবন্ধিক ডঃ শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মন্তব্য করেছেন : “মুকুন্দরামের কবিকঙ্কণ চণ্ডীতে ফুটোজ্জ্বল। বাস্তবচিত্রে, দক্ষ চরিত্রাহ্মণে, কুশল ঘটনা সন্নিবেশে ও সর্বোপরি, আখ্যায়িকা ও চরিত্রের মধ্যে একটি সূক্ষ্ম ও জীবন্ত সম্বন্ধ স্থাপনে আমরা ভবিষ্যৎকালের উপন্যাসের বেশ সুস্পষ্ট পূর্বাভাস পাইয়া থাকি। মুকুন্দরাম কেবল সময়ের প্রভাব অতিক্রম করিতে, অতীত প্রথার সহিত আপনাকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করিতে, অলৌকিকতার হাত হইতে সম্পূর্ণ মুক্তি লাভ করিতে পারেন নাই বলিয়াই একজন খাঁটি ঔপন্যাসিক হইতে পারেন নাই। দক্ষ ঔপন্যাসিকের অধিকাংশ গুণই তাহার মধ্যে বর্তমান ছিল। এ যুগে জন্মগ্রহণ করিলে তিনি যে কবি না হইয়া একজন ঔপন্যাসিক হইতেন, তাহাতে সংশয়মাত্র নাই।