সূরা ‘আল ক্বামার’ মক্কায় অবতীর্ণ কোরআনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সূরা। আল্লাহ তায়ালা এই সূরায় একটি বিশেষ আয়াত চার বার উল্লেখ করেছেন। সে বিশেষ আয়াতটির অর্থ হচ্ছে, 'অবশ্যই আমি শিক্ষা গ্রহণ করার জন্যে কোরআনকে সহজ করে দিয়েছি, অতএব আছে কি তোমাদের মাঝে কেউ এর থেকে শিক্ষা গ্রহণ করার?'
বিশ্বব্যাপী লক্ষ লক্ষ কোরআন পাঠকের মতো আমার মনকেও এক সময় এই আয়াতটি দারুণভাবে নাড়া দিয়েছে। বিশেষ করে যখন দেখি, আল্লাহ তায়ালার নাযিল করা আলোর এই একমাত্র উৎসটির ভাষান্তর করতে গিয়ে মানুষরা একে সহজ করার বদলে দিন দিন কঠিন ও দুর্বোধ্য করে ফেলছে। যে “আলো” একজন পথিককে আঁধারে পথ দেখাবে তা যদি নিজেই স্বচ্ছ না হয়, তাহলে 'আলো' সামনে থাকা সত্ত্বেও পথিক তো আঁধারেই হোঁচট খেতে থাকবে।
কোরআন লওহে মাহফুযের অধিপতি আল্লাহ তায়ালার কালাম, এর ভাষাশৈলী, এর শিল্প সৌন্দর্য সবই আল্লাহ তায়ালার একান্ত নিজস্ব। এ কারণেই বিশ্বের সব কোরআন গবেষকই মনে করেন, এই মহান গ্রন্থের যথার্থ ভাষান্তর কিংবা এর পূর্ণাংগ অনুবাদ কোনোটাই মানব সন্তানের পক্ষে সম্ভব নয় । যাঁর কাছে এই বিস্ময়কর গ্রন্থটি নাযিল করা হয়েছিলো তাঁকে আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং এর অন্তর্নিহিত বক্তব্য বুঝিয়ে দিয়েছিলেন বলেই তাঁর পক্ষে এই কিতাবের মর্মোদ্ধার করা সম্ভবপর হয়েছিলো। এ কারণেই কোরআন যাদের সর্বপ্রথম সম্বোধন করেছিলো রসূল (স.)-এর সে সাহাবীরাও কোরআনের কোনো বক্তব্য অনুধাবনের ব্যাপারে মতামত দেয়ার আগে রসূল (স.)-কে জিজ্ঞাসা করে নিতেন। যদিও তারা নিজেরা সে ভাষায়ই কথা বলতেন, যে ভাষায় কোরআন নাযিল হয়েছিলো। সম্ভবত এ কারণেই সাহাবায়ে কেরামদের বিদায়ের বহুকাল পরও ভিন্ন ভাষাভাষী কোরআনের আলেমরা কোরআনের অনুবাদ কাজে হাত দিতে সাহস করেননি, কিন্তু দিনে দিনে কোরআনের আলো যখন আরব উপদ্বীপ ছাড়িয়ে অনারব জনপদে ছড়িয়ে পড়লো, তখন কোরআনের প্রয়োজনে তথা ভিন্ন ভাষাভাষীদের সামনে কোরআনের বক্তব্য তুলে ধরার জন্যে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ভাষাকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা ছাড়া | তাদের কোনো উপায় থাকলো না। এমনি করেই অসংখ্য আদম সন্তানের অগণিত ভাষায় কোরআন অনুবাদের যে স্রোতধারা শুরু হলো, আমাদের মায়ের ভাষা বাংলায়ও একদিন এর প্রভাব পড়লো। কোরআনের পণ্ডিত ব্যক্তিরা একে একে এগিয়ে এলেন নিজেদের স্ব-স্ব জ্ঞান গরিমার নির্যাস দিয়ে এই অনুবাদ শিল্পকে সাজিয়ে দিতে ।
কোরআন আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে তাঁর রসূল (স.)-এর কাছে পাঠানো তাঁর বাণীসমূহের এক অপূর্ব সমাহার। সূদীর্ঘ ২৩ বছর ধরে বিপ্লবের সিপাহসালারকে তাঁর মালিক যে সব দিকনির্দেশনা দিয়েছেন তার অধিকাংশই বলতে গেলে পারিপার্শ্বিকতার বিশ্লেষণ— তথা এক একটি ঐতিহাসিক পটভূমির সাথে জড়িত। এ কারণেই কোরআনের তাফসীরকাররা কোরআন অধ্যয়নের জন্যে সমসাময়িক পরিস্থিতি জানার ওপর এতো বেশী জোর দেন।
তারপরও কোরআনের মূল অনুবাদ কিন্তু সমসাময়িক কোরআন পাঠকের কাছে জটিলই থেকে যায়। অনেক সময় মূল কোরআনের আয়াতের হুবহু বাংলা অনুবাদ করলে কোরআনের বক্তব্য মোটেই পরিস্কার হয় না। সে ক্ষেত্রে কোরআনের একজন নিষ্ঠাবান অনুবাদককে অনুবাদের সাথে ভেতরের উহ্য কথাটি জুড়ে দিয়ে বক্তব্যের ধারাবাহিকতা মিলিয়ে দিতে হয়। আরবী ভাষার ব্যাকরণ ও বাক্য গঠন প্রক্রিয়ায় এগুলোর প্রচলন থাকলেও বাংলাভাষায় এ বিষয়গুলো কোরআনের পাঠককে মাঝে মাঝে | দ্বিধাগ্রস্ত করে ফেলে । তারা হেদায়াতের এই মহান গ্রন্থে অনুবাদের অসংলগ্নতা দেখে বর্ণনাধারার 'মিসিং লিংক' খোঁজার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এ কারণেই সচেতন অনুবাদকরা এ সব ক্ষেত্রে নিজের কথার জন্যে 'ব্রাকেট' কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে ভিন্ন ধরনের টাইপ ব্যবহার করে সেই মিসিং লিংকটাকে মিলিয়ে দেন। আমাদের মধ্যে যারা 'তাফসীরে জালালাইন' পড়েছেন তারা সেখানে এ বিষয়টি বিশেষভাবে লক্ষ্য করে থাকবেন। এই তাফসীরে বিজ্ঞ তাফসীরকার তার নিজের কথাকে 'আন্ডার লাইন' করে আল্লাহ তায়ালার কথা থেকে আলাদা করে নিয়েছেন। কোরআনে এ ধরনের বহু আয়াত রয়েছে, এখানে উদাহরণ হিসেবে সূরা আল মায়েদা' ৬, সূরা ইউসুফ ১৯, সূরা ‘আর রাদ' ৩১, সূরা ‘আঝ ঝুমার’ ২২, সূরা ‘কাফ’ ৩ এ আয়াতগুলোর কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।