শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যে এক প্রথিতযশা লেখক। বাংলা উপন্যাসে তাঁর নিজস্ব জগতটি সুদূর বিস্তৃত । তাঁর লেখা সাহিত্যে যতটা গভীরতা রয়েছে তেমনি রসবোধের প্রকাশ ও সর্বত্র দৃশ্যমান । স্বাধীনতা-উত্তর কথা শিল্পীদের মধ্যে তাই তিনি অন্যতম খ্যাতনামা একজন বাঙালি লেখক । হাসির মোড়কে কল্পবিজ্ঞানের গল্প লেখার জন্যে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের জুড়ি মেলা ভার। বরোদাচরণ, ফটিক এবং শবর দাশগুপ্তর মতো প্রাপ্তবয়স্কদের জন্যে লেখা চরিত্রগুলির জন্যও অপার খ্যাতি অর্জন করেছেন তিনি।
তাঁর লেখা অনেকগুলি উপন্যাস এর উপর বিভিন্ন চলচিত্র নির্মাণ ও করা হয়েছে । শিশুসাহিত্য থেকে শুরু করে প্রাপ্তবয়স্কদের অন্তরাত্মায় অবলীলাক্রমে বিচরণ শীর্ষেন্দুর। তাঁর এই অবাধ গতি ই সৃষ্টি করেছে মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি থেকে মানবজমিন, পার্থিব কিংবা পাতালঘরের মতো সাহিত্য । বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে এইমুহূর্তে প্রবাদপ্রতিম এই সাহিত্যিককে বাংলা সাহিত্যের জীবন্ত কিংবদন্তি হিসেবে আখ্যায়িত করলে পাঠকমহলেরর তরফে যে কোনও আপত্তি আসবে না সে ব্যাপারে সকলেই নিশ্চিত ।
১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ২ নভেম্বর ময়মনসিংহে জন্মগ্রহণ করেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ময়মনসিংহে তার জীবনের প্রথম ১১ বছর অতিবাহিত হওয়ার পর তার বাবা কলকাতায় রেলের চাকরি পেয়ে চলে আসেন।
তারপর তিনি তার পরিবারের সাথে কলকাতায় মনোহরপুকুর রোডে একটা ফ্ল্যাটে থাকতে শুরু করেন। পিতার রেলে চাকরি সূত্রে অসম, বিহার, পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে থেকেছেন তিনি। কাটিহারে ক্লাস টু তে ভর্তি হবার সময় ভীষণ দুষ্টু ছিলেন তিনি একথা আমার জীবনকথা’য় আত্মকথায় বলেছেন তিনি।
কাটিহারে থাকার সময় তিনি প্রথম গল্পের বই পড়া শুরু করেন, পত্রিকা পড়তেন নিয়মিত, সেই সময় খবরের কাগজে যুদ্ধের কথা, দুর্ভিক্ষের পরিবেশ চারিদিকে। কাটিহারের পর তারা যান মালজংশনে, মালজংশন থেকে তারা গেলেন দোমোহানিতে, তারপর ময়মনসিংহে, সেখান থেকে আসামে।
কুচবিহার ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে আইএ পাস করে পাকাপাকিভাবে আবার কলকাতায় চলে আসেন। ১৯৫৫ সালে সিটি কলেজে বাংলা অনার্স নিয়ে ভর্তি হন। পরবর্তীকালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এমএ পড়েছেন তিনি।
কর্মজীবন ও সাহিত্যজীবনের মাঝে নিজেকে চেনা
তার প্রথম গল্প ‘জলতরঙ্গ’ ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তার প্রথম উপন্যাস ‘ঘুণপোকা’ দেশ পত্রিকার পূজাবার্ষিকীতে প্রকাশিত হয়। তার প্রথম কিশোর উপন্যাস মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি।
মেদিনীপুর জেলার নারায়ণগড়ের একটি বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে কিছুদিন কাজ করার পর তিনি ১৯৬১ সালে তাঁর প্রকৃত কর্মজীবন শুরু করেন কালীঘাট ওরিয়েন্টাল একাডেমীতে শিক্ষকতার মাধ্যমে।
একাকীত্বের যন্ত্রণা আর মৃত্যুভয় তার মনে বাসা বাঁধে সেইসময়, ১৯৬৫ সাল নাগাদ তিনি ঠাকুর অনুকূল চন্দ্রের কাছে আশ্রয় নেন এবং ঠাকুরের বানী শুনে অবসাদ থেকে তার মুক্তি লাভ ঘটে। ‘ঘুনপোকা’ প্রকাশিত হওয়ার পরের বছর তিনি তার বান্ধবী সোনামন চক্রবর্তীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন এবং তার এক পুত্র সন্তান এবং এক কন্যাসন্তান হয়। ১৯৭৫সালে তিনি আনন্দবাজার পত্রিকায় যোগদান করেন। দীর্ঘকাল দেশ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন তিনি।
নিজের লেখার ধরন সম্পর্কে তিনি বলেছেন হঠাৎ একটা লাইন এসে যায়। ওই যেমন তুলোর থেকে একটা একটা করে সুতো বেরিয়ে আসে, তেমনি ওই লাইন থেকে শব্দেরা ভিড় জমায়। ভাবনা শুরু হয়, চরিত্র আসে, ঘটনা আসে। আমি শব্দ দিয়ে ছবি দেখতে আরম্ভ করি।
উপন্যাসে স্বতন্ত্রতা
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় সকল প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন আধ্যাত্মিকতাবাদের মধ্যে। তাঁর লেখায় তিনি অনুসন্ধান করে চলেছেন জীবনের সত্যতা, তাঁর উপন্যাসে উঠে এসেছে দেশভাগ, নকশাল আন্দোলন উদ্বাস্তু সমস্যার কথা, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় প্রথম উপন্যাস ‘ঘুনপোকা’তে দেশভাগের কথা এসেছে।
তিনি যখন ক্লাস সিক্স-সেভেনে পড়েন তখন দেশভাগ হয়,তিনি খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন দেশভাগের যন্ত্রণা।যা তাঁর সাহিত্যে রচনাতেও উঠে এসেছে বারবার। তিনি পচ্ছন্দ করতেন না সম্পর্কে গোপনীয়তা, সত্যিকে তিনি প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছেন বারবার
ছোটগল্পে স্বতন্ত্র্যতা
বাইরের ঘটনাবহুল জগত নয় বরং মানুষের অন্তর্জগৎ এর জটিলতা, আমিত্ব’র অসহায়তা ধরা পড়েছে তার ‘আমরা’ এবং ‘আমাকে দেখুন’ গল্পদুটিতে। তাঁর ছোটগল্পগুলি আমাদের এক নতুন জগতে অবতীর্ণ করে, যেখানে অস্থিরতা নয়, থাকে বিশ্বাস।
সাহিত্যে তাঁর অবদানের জন্য তিনি বিভিন্ন পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন। শিশু সাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯৮৫ সালে তিনি বিদ্যাসাগর পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৮৮ সালে ‘মানবজমিন’ উপন্যাসের জন্য তিনি সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার পান। ২০১২ সালে বঙ্গবিভূষণ পুরস্কারে সম্মানিত হন। এছাড়াও তিনি ১৯৭৩ এবং ১৯৯০ সালে আনন্দ পুরস্কার পেয়েছেন।